এতেও লাভ দেখছে ব্রাজিল?

বেশ জনপ্রিয় একটি প্রবাদ আছে- রোম যখন পুড়ছিল নিরো তখন বাঁশি বাজাচ্ছিল। সত্যিই কি তা-ই; তা-ই কি হয়? কিন্তু ইতিহাস বলছে এই প্রবাদ অনেকাশংই সত্য। রোমান সাম্রাজ্যের পঞ্চম সম্রাট ছিলেন এই নিরো। তার বংশধরদের মধ্যে তিনিই ছিলেন সবচেয়ে অজনপ্রিয় রাজা। এমন কোনো অপকর্ম নেই, তার শাসনামলে হয়নি।

কথিত আছে- নিজের মাকে পর্যন্ত হত্যা করেছেন তিনি। তার সময় রোমে ভয়াবহ অগ্নিকা-ের সূচনা হয়। টানা ছয় দিন পর্যন্ত আগুনের লেলিহান শিখা জ্বলতে থাকে। রোমবাসীদের ধারণা, নিরো ইচ্ছে করেই সেই আগুন লাগিয়েছিলেন। কেননা ধ্বংসস্তূপের ওপর তিনি তার স্থাপত্যকর্ম নির্মাণ করতে চেয়েছিলেন।

এই কথার সত্যতা পাওয়া যায়, ওই ঘটনার পর নিজের ইচ্ছের বাস্তবায়ন করতে প্রজাদের ওপর বাড়তি করের বোঝা চাপিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। এ কারণে লোকে বলে, রোম যখন পুড়ছিল নিরো তখন বাঁশি বাজাচ্ছিল।

এই একবিংশ শতকে এসেও বিশ^বাসী আরেক ‘নিরো’কে প্রত্যক্ষ করছে। বিশে^র সর্ববৃহৎ চিরহরিৎ বন ব্রাজিলের আমাজন যখন পুড়ছে, তখন সে দেশের প্রেসিডেন্ট জইর বোলসোনারো অনেকটা ইতিহাসের সেই নিরোর মতো আচরণ করছেন। বলছেন, এটা ব্রাজিলের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। দাবানল যখন একের

পর এক নতুন অঞ্চল গ্রাস করছে, এমন শোচনীয় সময়েও বাইরের দেশের সহায়তা ফিরিয়ে দিচ্ছেন। এ জন্য সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে তাকেও এই সময়ের নিরো বলে উপহাস করছেন অনেকে। বলছেন, আমাজন যখন পুড়ছে বোলসোনারো তখন বাঁশি বাজাচ্ছেন!

আমাজন বনকে পৃথিবীর ফুসফুস বলা হয়, কারণ এই বন বায়ুম-লে থাকা বিষাক্ত কার্বন ডাইঅক্সাইডের দুই কোটি মেট্রিক টন শোষণ করে থাকে। আর তার বিপরীতে প্রাণিকুলের বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় অক্সিজেনের ২০ শতাংশ সরবরাহ করে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে জীববৈচিত্র্যে যে আঘাত আসার কথা, সেটি থেকে অনেকটাই রক্ষা করছে এই আমাজন।

আর এই পৃথিবী রক্ষাকারী জঙ্গল পুড়ছে আগস্টের ১৫ তারিখ থেকে। এই শুষ্ক মৌসুমে আমাজনে আগুন খুব একটা অপরিচিত নয়। প্রায় প্রতিবছর কিছু না কিছু অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটে থাকে। কিন্তু এ বছর ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। ব্রাজিলের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা বলছে, চলতি বছর ৮০ হাজার অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটেছে অথবা ঘটানো হয়েছে, যা গত বছরের তুলনায় ৮৪ শতাংশ বেশি।

অন্যদিকে নিউইয়র্ক টাইমস জানিয়েছে, যেসব এলাকায় আগুন লেগেছিল ইতোমধ্যে সেসব এলাকা কৃষিকাজের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে। কাজেই সঙ্গত কারণেই সন্দেহ ঘনীভূত হয় যে, কৃষিজমি বাড়ানোর জন্যই আমাজনে কিছু আগুন ইচ্ছে করে লাগানো হয়েছে। আর এই বিষয়টিও বোলসোনারোর বন-নীতির সঙ্গে যায়। তিনি সাধারণ বনাঞ্চল ধ্বংসের নিন্দা করেন না; বরং তিনি বনাঞ্চল কমিয়ে কৃষিজমি বাড়ানো এবং সেসব এলাকা থেকে খনিজ সম্পদ উত্তোলনের পক্ষে।

আর এ কারণে আমাজন যখন পুড়ছে, তখন বোলসোনারো না কার্যকর পদক্ষেপ নিচ্ছেন না অন্য দেশের সহায়তা কামনা করছেন। আবার একই সঙ্গে তাকে বলতে শোনা গেছে, এই আগুন নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা ব্রাজিলের নেই। আবার ইউরোপীয় নেতৃবৃন্দ যখন ২২ মিলিয়ন ডলারসহ সব ধরনের সহায়তার প্রস্তাব দিলেন, সেটা তিনি ফিরিয়ে দিলেন। তার কথা, ব্রাজিল হলো কুমারী মেয়ের মতো, তার প্রাকৃতিক সম্পদের দিকে ইউরোপের বিকৃত রুচির দেশগুলোর চোখ পড়েছে। এসব কারণে বোলসোনারোর নীতিকে কঠোর সমালোচনা করছেন পরিবেশবিদরা। কেননা তিনি পুড়ে যাওয়া আমাজনেও লাভ দেখছেন।

সর্বশেষ পরিস্থিতি হলো, চাপের মুখে ব্রাজিল সরকার কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। ৪৪ হাজার সেনা মোতায়েন করা হয়েছে। পাশাপাশি চিলির সহায়তা নিচ্ছে ব্রাজিল। কিন্তু আমাজনের আগুন নিয়ন্ত্রণের ইতিবাচক খবর এখনো পাওয়া যায়নি। পরিবেশবিদদের আশঙ্কাÑ আরও বিস্তীর্ণ এলাকা আগুনের মুখে যাবে।

দক্ষিণ আমেরিকার সবচেয়ে বড় অর্থনীতির দেশ ব্রাজিল। আর বিশে^ জিডিপির দিক থেকে নবম। অর্থনীতির সূচক অনুযায়ী দক্ষিণ আমেরিকার এ দেশটি পণ্য রপ্তানিতে ২২তম স্থান ধরে রেখেছে। অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে ডানপন্থি সরকার মনে করছে, তার কৃষিজমি বাড়ানো প্রয়োজন। পাশাপাশি পশুপালনের জন্য চারণভূমি প্রয়োজন। সব মিলিয়ে বন উজাড় করে অর্থনীতি সম্প্রসারণের নীতি গ্রহণ করছে। কিন্তু উন্নয়নের এ ধারণা এখন অচল হয়ে পড়েছে। যদি মানুষই না বাঁচে তা হলে কার জন্য উন্নয়ন? আর বৈশ্বিক উষ্ণতা যেভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে, তার মোকাবিলায় বন রক্ষার বিকল্প নেই। বিষয়টি বোলসোনারোর মতো রাষ্ট্রনায়করা যত দ্রুত উপলব্ধি করতে পারবেন, ততই পৃথিবীর জন্য মঙ্গল।

আপনি আরও পড়তে পারেন